সবাইকে স্বাগতম

এই ব্লগ সাইট ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না এ পেইজ গুরে আসার জন্য সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো লাগলে আবার আসবেন। *** শিক্ষার কোন বয়স নাই, জানার কোন শেষ নাই। )

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ত্যাগ


ত্যাগ

  আপনাদের কি ইবোলা ভাইরাসের কথা মনে আছে ?
 সেই ইবোলা ভাইরাস নিয়ে আমার হৃদয় ছোয়া একটা গল্প । বেশি কিছু না বলে মূল গল্পে আসি,

                                                           প্রথম অংশ 

মজু মিয়া মিঞা বাড়ির বড় ছেলে । তার বড় ছেলেটা ঢাকার একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে । বড় ছেলেকে নিয়ে তার স্বপ্নটা ও অনেক বড় । আর ছোট ছেলেটার পড়া লেখায় তেমন মন নেই । ঠিক মতো স্কুলে যাওয়া তো হয়না তার উপর সঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পাড়ার বাজারের চায়ের দোকানে সারাক্ষন হইহুল্লাহ । তাইতো কেউ কেউ ছেলের কর্মের জন্য মজিদ মিয়ার কাছে হালকা নালিশ করে , ছেলেটাকে কি শাষন করোনা ? ওতো ভারী বেয়াদব হইতাছে ।
 মজু মিয়া তখন দাঁতের উপর দাঁত চেপে রাগে বিড় বিড় করে । আর ভাবে আমি আর কত বা করবো কাজের কথা বললে  কাজে ও আসেনা । পড়া লেখাও ঠিক মতো করে না , যদি নাই শুনে আমার আর কি ? চেষ্টাতো আমি করতাছি , বড় ছেলেটার চিন্তা করি না । এইতো আর একটা বছর ছেলেটার এম বি এ টা শেষ হলে উপরে ওয়ালার রহমতে একটা চাকুরী হয়ে গেলে ওর পথটা তো ও করে নিবে আমি আর একটা বছর কষ্ট করে টাকা পয়সা যোগান দিতে পারলে হয় ।
আশ্বিনের দুপুরে ঘাম জড়ানো শরীরে এগুলো ভাবে আর সবজির ক্ষেত পরিচর্যা করে মজু মিয়া ।
আজ রোদ পড়ছে বেশ , তাই মজু মিয়ার ভালোই পানির পিপাসা পেয়েছে । পানি পান করতে হলে ঐ যে বড় রাস্তার পাশের একটি বাড়িতে যেতে হবে । এ দিকে দুপুর গড়িয়েছে ক্ষেতের কাজ ও একটু বাকি , তাই মজু মিয়া চিন্তা করতাছে কাজটুকু শেরে একবারে চলে যাই । এরকম টা ভেবেই আবার ক্ষেতের কাজে মনোযোগ দেয় মজু । এমন সময় মজু মিয়া শুনতে পায় ,
মজু মিয়া  ও মজু মিয়া , দুপুরের খানা দানার কথা কি মনে নাই ? নাকি কাজ করতে করতে ভুলেই গেছো । আরে ও মিয়া এ দিকে আসো একটু গাছ তলায় বসে জিরাই নাও ।
মজু মিয়া সারা দিয়া বলে কে গনি ভাই, বহ আইতাছি ।
গনি মিয়া  মজু মিয়ার পাশের ক্ষেতের মালিক অতপর মজু মিয়া গামছাটা খুলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে এসে গনি মিয়ার সাথে গাছ তলাই বসে । গনি মিয়া একটা বিড়ি বের করে মজু মিয়াকে বলে,
ধরো বিড়িটা লাগাও, এত কাজ করে কি হবে? কাজ তো সারা জীবনও করলা ! মজু মিয়া বিড়িতে আগুন ধরাইয়া টানতে লাগলো । গনি মিয়া বলে তাতো মিয়া বড় ছেলেকে তো বহুত পড়ালেহা শিখাইতাছো,
হ' ভাই আপনাগো দোয়া । ভাই ,দোয়া করবেন আমার পোলাডা যেন মানুষ হইতে পারে ।
ধুর মিয়া কি যে কও ? তোমার পোলা তো আমাগো পোলা। দোয়া করি তোমার পোলা মানুষের মতো মানুষ হউক ।
তো মজু মিয়া , তোমার তো সুদিন আইতাছে তোমার আর কি চিন্তা ?
চিন্তা তো আছে গনি ভাই  ।
 সেটা আবার কি চিন্তা ? মজু মিয়া ।
 ভাই এই চিন্তাটা আমার ছোট ছেলে মমিন মিয়াকে নিয়ে,
হের আবার কি হইছে ?
কি আর হইবো পড়া লেখায় এক দম মন নাই তার উপর সারাদিন বখাটে ছেলেদের সাথে চলা পেরা, আমার কথা একদম হুনে না । সারাক্ষন আমার আড়ালে আড়ালে চলাফেরা করে , আমি যে এখন কি করি গনি ভাই ,এই চিন্তাটা সারাক্ষন মাথায় ঘুরা ঘুরি করে ।
তো মজু মিয়া তোমার মমিন মিয়ার বয়স কত অহনে ?
তা আর কত হইব ১৭-১৮ হইব আর কি ।

তাহলে হুনো (শুনো) ওর যখন পড়া-লেহায় মন বহেনা, ক্ষেতের কাজ কামও করতে চায়না । তয় হেরে বিদেশে পাঠায়া দেওনি ভালা । ঔখানে গেলে আশা করি সব ঠিক হয়ে যাইবো বুঝলা ,মজু মিয়া।
ভাই আপনি যহন কইতাছেন ,আমি একটু হের মায়ের লগে কথা কইয়া দেখি হে কি কয় ।
তো ঠিক আছে মজু মিয়া ,আজ যাই তুমি ভাবনা চিন্তা কইরো ,পরে অন্য এক সময় কথা হইবো তো যাই ।
 হ ভাই দোয়া করবেন বলে,
যে যার মত পথে পা বাড়ালো নিজ বাড়ির উদ্দেশ্য । 

                                দ্বিতীয় অংশ 

মজু মিয়া দিনের সকল কাজ শেষে রাতের খাবার শেরে একটা বিড়ি ধরিয়ে মমিনের মায়ের সাথে বসে মমিনের বিদেশ পাঠানোর ব্যাপারে , স্ত্রী সম্মতির কথা জানতে চাইলে স্ত্রী প্রতি উত্তরে বলল,
তুমি যেটা ভালো মনে কর হেইডাই আমার কাছে ভালা । পোলাগো ভালার লাইগাই তো তুমি দিন-রাত এত খাটা-খাটুনি করো । ওগো লাইগা যেটা ভালা হেইটাই তো আমরার ভালা ।
তয় তুমি ছেলেরে বুঝাইয়া কও আর হের মতামত জানও । বলতে বলতে মজু মিয়া বিছানায় গা এলিয়ে দিল । বেশি সময় নেয়নি ক্লান্ত শরীরের চোখ জোড়া, ঘুম পরির দেশে যেতে ।
এদিকে গুন গুন করে গান , গাইতে গাইতে মমিন মিয়া বাড়ির সামনের গেট মাড়িয়ে উঠানে প্রবেশ করল । তার পা দুটি চলছিল ঠিক উঠানের উত্তর দিকের ঘরটার দিকে, যে ঘরটাতে মমিন মিয়ার রাত্রী যাপিত হয়, এটাই তার শোবার ঘর । এমন সময় জ্বলন্ত হ্যারিকেন হাতে মমিনের সামনে দাঁড়িয়ে গেল তার মা সাথে সাথে মমিন বলে উঠলো...
মা তুমি অহনো ঘুমাও নাই । বেশি রাত জাগলে তোমার না মাথা ব্যথা করে ।
তো বাপ জান মায়ের নিয়া এতো চিন্তা তো এত রাত কইরা বাড়ি ফিরতে হয় কির-লাইগ্যা। সারাদিন তোমার বাপজান যে রোদে পুরে ক্ষেতে খামারে কাজ করে হেইদিকে তোমার কোন খেয়াল আছে । বাপের কষ্ট টা একটু তো বুঝবার চেষ্টা করো না । অমনি কাম করতে করতে তোমার বাপজান একদিন মইরা পইরা থাকবো দেখবা ।
এইসব তুমি কি কও মা, বাপজান কি ? আমাগো মেম্বারের মতো অন্যের হক মাইরা খায়নি , যে বাজান রাস্তায় মইরা পইরা থাকবো।
হ হইছে অহন হাত মুখ ধুইয়া অহো আমি খাওয়ন দিতাছি ।
হ' আমি হাত মুখ ধুইয়া আইতাছি ।
মমিন হাত মুখ দুয়ে মায়ের আঁচল দিয়ে মুখটা কোন রকমে মুছে খাইতে বসে ।
বাপজান ..
তোমার ভাইজান যে এতো পড়া লেহা করতাছে তোমার হের মতো পড়া লেহা করতে ইচ্ছে হয়না ?
না মা আমার এতো পড়ালেহা করতে ইচ্ছে করে না ।  হুন মা, ভাইজানের মতো তোমাগো ছাইরা দূরে থাকতে হইবো হেইডা আমার ভালা লাগেনা। আর তহন তোমাগো দেখা শুনা করবো কেডায় । এর চাইতে ভালা, ভাইজান চাকরি কইরা টাকা পাঠাইবো আর আমি তোমাগো দেখা শুনা করুম।
ও ..হেইডা  তাইলে তুমি ভাইজানের পাঠানো টাহা (টাকা) দিয়া আমরার দেখ শুন করবা, নিজে কিছুই করবা না ? ভাইজান করলে আমাকে ক্যান করতে হইবো ।
তোমার ভাইজান যদি তোমার জন্য টাহা না পাঠায়, তহন কি করবা । হেয় যদি শুধু আমরার নামে টাকা পাঠায়, তোমারে টাহা দিতে না কইরা দেয় ।
 মা তুমি জানোনা ভাইজান এমন কাম কোন দিন করবো না । হেয় অনেক লেখা পড়া করতাছে না, আর আমি হের আপন মায়ের পেটের ভাই ।
হুন, বাপজান একজনের কামাইনা  টাহা, অন্য জন খাইবা আমরার কাছে হেইডা ভালা লাগবো না বাজান ।
তাই তোমার বাজান চায়, তুমি একটা কিছু করবা ।
তয় ঠিক আছে মা আমি কি করুম কও?
তোমার বাপ জান চায় তুমি বিদেশ যাইবা ,  টাহা পয়সা হইলে দেশে ফিরা একটা কিছু করবা, সাথে তুমি আমাগো দেখ ভাল করবা ।
মা তোমারে আর বাপজান  ছাইড়া আমার কোথাও যাইতে মনে চায়না । তোমাগো কিছু হইলে ক্যাডা দেখবো কও?  আমরা তো অহনে ভালাই আছি চলতে ফিরতে পারি , হের লাইগা তো তোমার বাজান কয় তারা তারি বিদেশ গিয়া, টাহা জমাইয়া তারা তারি দেশে আসবা কি কও বাজান ।
বাপজান যখন চায় আমি বিদেশ যামু ,তয় মা আমি বিদেশ বেশি দিন থাকুম না কইলাম, বাজানরে কইয়া দিও ।
হ বাজান তোমাগো ছাইরা তো আমারাও ভালা থাকবার পারুম না ।
মমিনের মা মমিনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে
অহন তুমি ঘুমাও বাজান আমিও গিয়া ঘুমাই ।
মা তুমি বেশি চিন্তা করবা না, তোমরা যেইডা ভালা বুঝবা আমি তায় করুম।
হ বাজান.........
বলতে বলতে মমিনের মায়ের সরল দুটি চোখের কোণের ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার হাতে গড়া উঠানের শুস্ক মাটির বুকে । 
                                             
                                            তৃতীয় অংশ 
 ছেলে রাজি হইছে শুনে মজু মিয়া আদম ব্যবসায়ীর সাথে কথা বার্তা শুরু করলো । মজু মিয়া সারা দিন ক্ষেত খামারের কাজ আর সকাল সন্ধ্যা ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর তৎপরতা চলতে থাকে ।এটা যেন মজু মিয়ার এখন নিত্য দিনের কর্ম হয়ে দাড়িয়েছে, পাসপোর্ট হতে শুরু করে ভিসা পযন্ত চললো তার নিপুন কাজের ছোয়া। যেন নিজ হাতের নিখুত দলিলে নিজের ছেলের পরবাসে পাঠানোর প্রক্রিয়াটা , মজু মিয়া সবজি ক্ষেতের সফল কাজের মত সফল করল, টানা ৬মাস ছোটা ছুটির পর । অবশেষে আসল সেই প্রত্যাশিত দিন । যে দিন মমিন তার যাত্রা শুরু করবে এক অপরিচিত অজানা এক প্রকৃতির ভৌগলিক সীমারেখা পেরিয়ে অন্য কোন জাত ধর্ম বর্ণ সংস্কৃতির ছোয়ায়, এক সীমানা রেখার ভিতরে যেখানে শুধুই তাহাদের নিয়ম নীতি ।
ছেলের প্রয়োজনীয় সব গোছাতে গিয়া মমিনের মায়ের মনের ভিতরে কেমন যেন এক শিহরন জাগে । সরল চোখ জোড়ায় রাজ্যের অশ্রু যেন বাধ ভাঙ্গার অপেক্ষায় ।সে দিন মা মমিনের পছন্দের তালিকার সব খাবার রান্না করেও ছেলেকে কিছুই খাওয়াতে পারলো না । খাবে কি করে, মমিনের মনটা তো আর পাথর নয় তার ভিতরে ভিতরে যেন সব চুর মার হয়ে যাইতাছে । সে ঠিক মতো মা বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারে না,  তার ভাইজানও আসে নাই ।ঢাকা থেকে তাকে বিদায় জানানোর জন্য ওখানেই আছে । মমিন আর কি বা করবে, ভিতরের সব মর মরানি চেপে রেখে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে, যাতে মা বাবা ভেঙ্গে না পড়ে । একই অবস্থা মমিনের মায়েরও........
আর মজু মিয়া, তার অবস্থা বলতে গেলে পাকা টমেটো, বাহিরে শক্ত বোঝার উপায় নেই ভিতরে গলে গলে একাকার । যেন দৈত্য পুরীর রাগী দৈত্যের মত নিজের সন্তানকে মাথার উপর তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলে হত্যা করার সামিল । আজ মজু মিয়ার বুকের ভিতর টা এমন টনটনে অনুভব করছে ,  সেই ছোট বেলায় তার বাবার মৃত্যুতে তার মনটা ঠিক এমন করে দপ দপ করে উঠেছিল । আজ বহু দিন পর আবার একটু বেশি অস্থির হয়ে পড়েছে মজু মিয়া ।
মমিন বাড়ি হতে বিদায়ের আগে মায়ের সাথে বার বার কথা বলার চেষ্টা করেও কোন কথা বলতে পারছিল না । কেন যেন আজ মায়ের সাথে কথা বলতে গেলেই গলা ভেঙ্গে যায়, আর বেশি বেশি কান্না পায় । আর পোড়া চোখ দুটির উপর যেন এক বর্ষার সব পানি এসে ভর করেছে । তাই নিজেকে সামলে নিয়ে ,মমিন আজ অভিনেতা হয়ে যায় নিজের অজান্তে।
মমিন মাকে বলল.................
মা বেশি চিন্তা করো না ।
ব্যস, এই টুকু বলে মুখ ফিরিয়ে বাড়ির বাহিরের পথে হাটা শুরু করলো । কিন্তু তাতে কি আর এক বর্ষার এত পানি ঐ দুটি ছোট্ট ছোখে ধরে রাখা যায় ? কেই বা সেটা পারবে । তাই মমিন ও পারলো না, তার গাল গড়িয়ে গড়িয়ে নিঃশব্দে ফোটা ফোটা জল পড়তে থাকল...    সেটা নিছক শুধু ফোটা ফোটা জ্বল ছিল না এর সাথে মিশে ছিল অন্য কিছু ।
এ দিকে মমিনের মা রাস্তার পাশের ছোট নিম গাছ টাকে ধরে শরীলের সব শক্তি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে চাই,
আমার বাজান, আমার মমিনকে কই লইয়া যাইতাছো । ওরে আমার কাছ তন লইয়া যাইতে পারবানা, আমার জীবন থাকতে যাইবার দিমুনা , আমার জীবন থাকতে ওরে লইয়া যাইতে দিমু না । কিন্তু কেন যেন চিৎকার করতে গিয়া বার বার গলায় এসে সব শক্তি মিলিয়ে যাচ্ছে । মমিনের মায়ের বাক শক্তিটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে ছেলের সাথে সাথে । এ যেন এক নির্বাক চলচিত্র , তুমি অভিনয় করে যাবে অঙ্গ ভঙ্গি দিয়ে, কথা বলবে কিন্তু আওয়াজ হবে না ।
ঠিক তাই, কথা বলার নার্ভটা যেন তার সব শক্তিএখন হারিয়ে ফেলেছে। দেখতে দেখতে ছেলে আর স্বামী দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল,তখন অশ্রু যেন তার নিজ ধারায় ঝাড়তে শুরু করলো, নাক টাও তার সাথে সঙ্গ দিতে শুরু করলো । মমিনের মা আর এগুলোকে আটকানোর বৃথা চেষ্টা করল না । তাই তারা নিজ নিজ ধারায় বইয়ে যেতে থাকলো............... 

                                         
                                          চতুর্থ অংশ 

অবশেষে ঢাকা বিমান বন্দরে.........
এর আগে রাস্তায় বাবার সাথে মমিনের তেমন কোন কথা হয় নাই । দুজনে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ঢাকায় আসার পথটা পাড়ি দিয়েছে । তবে হোটেলে দু একটা কথা হয়েছে তা আবার আদম ব্যবসায়ীর উপলক্ষে । বিমান বন্দরে মমিন ভাইজানকে কাছে পেয়ে জরিয়ে ধরে অনেক ক্ষন ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদলো , কেঁদে কেঁদে নিজেকে আগে হালকা করে নিল । মমিন বলল..
ভাইজান আপনি সময় করে বেশি বেশি বাড়িতে যাবেন, বাপজান আর মার প্রতি খেয়াল রাখবেন, সব অহন আপনারে করতে হইবো, আমি তো আর যখন তখন আইতে পারুম না ।
 ঠিক আছে, আমি বাপজান আর মার খেয়াল রাখবো, তুই তোর খেয়াল রাখিস ,নিয়মিত ফোন করবি ঠিক মতো কাজ কর্ম করবি , কাজ ঠিক ঠাক মতো পাইলি কিনা জানাবি ।
ভাইজান তুমি বাপজান রে বুঝাইয়া কইও , আমার লাইগা যেন চিন্তা না করে । আমি ঐহানে গিয়া ঠিক ঠাক সব কাজ করুম, কারো লগে আড্ডা দিমুনা আর ঐহানে তো সঙ্গী সাথী কেউ নাই ।
এসব বলতে বলতে বুকটাকে একটু হালকা করে শেষ মেষ বিমানে উঠে পড়ল মমিন । এক সময় বিমান আকাশে পাখির মত উড়তে শুরু করল । মজু মিয়া আর তার ছেলে বিমানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল । ততক্ষনে মজু মিয়ার চোখ দুটি যেন ঝাপসা হয়ে এসেছে । মজু মিয়া বুঝতে পারতেছে আজ বুঝি শেষ রক্ষা হবেনা ,শত চেষ্টাতেও চোখের ভিতরের জল টাকে আজ আটকাতে পারলোনা, সেটা বাহিরে গড়িয়ে পরতে লাগলো অবশেষে। তারপর নিঃশব্দে কেটে গেল কিছুক্ষণ...অতপর ছেলে কে নিয়ে ফিরে গেলেন ছেলের মেস বাসায় । রাতটা ওখানে কাটিয়ে সকালে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো মজু মিয়া ।
সেই দিন হতে মমিনের মায়ের ঘুম খুব একটা ভালো হয় না , মজু মিয়ারও একই দশা । কাজ কর্মে তেমন একটা জোস আসেনা মনটা কেমন যেন উতালা হয়ে থাকে সব সময় । যেখানে যায় কেমন যেন একটা শুন্যতা আর হা হা কার । ঠিক বুঝতে পারে মজু মিয়া এই  শুন্যতা আর হা-হা কার কিসের, ছেলের জন্য এই শুন্যতা এই উদাসীনতা । 
আজ ষষ্ঠ দিনে গড়িয়েছে ছেলের বিদেশ যাত্রা । এই হিসাব টা আর কেউ না রাখলেও মমিনের মায়ের নিকট ইহা ভুল হবার নয় । তাইতো অনুরাগের সুরেই স্বামীকে বলে উঠলো .. 
 তুমি এত পাষান ক্যান, ছয় ছয়টি দিন পার হইয়া গেল,আর তুমি পোলাডার একটা খবর নিবার পারলা না ।
 কেমনে খবর নিব কও ? হেই চিন্তাই তো করতাছি । হের খবরের লাইগা মনটা বড়ই আনচান করতাছে বউ । তুমি মাইয়া মানুষ কাঁদবার পার ,আমি পুরুষ মানুষ কাঁদবারও পারিনা । তুমি কান্না কাটি কইরা কষ্টটা অন্যেরে বুঝাইতে পার আর আমি.........
মমিন যাবার সময় বইলা গেল বাবজান আমি তোমারে ফোন কইরা জানামু। কি ভাবে আছে উপর ওয়ালা জানে ।
 হুন, আমি তোমারে কষ্ট দিবার লাইগা হেই কথা কই নাই । তুমি গোসল সাইরা সদরে একবার হেই আদম ব্যবসায়ীর লগে দেহা করো , হেয় একটা ভালা-মন্দো কিছু কইতে পারবো । 
হয় তুমি ঠিক কইছো বউ । 
এই বলে মজু মিয়া পুকুর পাড়ের দিকে রওনা হলেন গোসল করার জন্য । মজু মিয়ার যেন একটা মিনিট ও আর তর সইতেছিল না,ছেলের খবর জানার লাইগা । তাইতো হন্ত দন্ত করে ছুটছে মজু মিয়া আদম ব্যপারির উদ্দেশ্য ,যথাযত ভাবে আদম ব্যপারির অফিসে  পৌছাল ঠিকই । কিন্তু আদমব্যপারি বাহিরে থাকায় আজ ও ছেলের কোন খবর জানতে পারলো না । বিষন্ন মনটা নিয়ে হেলে দুলে বাড়ির পথে হাটতে শুরু করল  মজু মিয়া । আজ মজু মিয়ার মাইলের পর মাইল ছুটে চলা পা দুটি ও যেন বাধ সেধেছে তার মনটার মতো ,যেন তাল লয় সব হারিয়ে ফেলেছে।

                                            
                                         পঞ্চম অংশ 
 
মজু মিয়া ও তার স্ত্রী রাতের খাবারের নামে একটুখানি ভাতের সাথে কয়েক গ্লাস পানি দিয়ে যেন পেঠের ক্ষুদাটারে সান্তনা দিলেন মাএ। দুটি মানুষের ভাত তরকারি  যেমন ছিল তেমনি থাকলো । এটা শুধু আজ নয় এটা বিগত ছয়টি দিন ধরে চলে আসছে, স্বামী স্ত্রী খুব একটা কথা বার্তা ও হয়না দু জনই উদাসীন হয়ে আছে, ছেলের একটা খবরের প্রত্যাশায় । রাত গুলিও এখন তাদের দু- জনার  কাটে শুধু  বিছানায় এপাশ ওপাশ করে । তবুও তো রাতের নিয়মে বিছানায় গিয়ে গা দিতে হয় । তাই হয়তো সদ্য-বিদেশ গমন কারী মমিনের মা বাবা সেটাই করেন নিয়মের খাতিরে । টেবিলের উপর হ্যারিকেন টা নিভু নিভু আলোয় টিপ টিপ করে জ্বলছে, যেন এই বিপুল অন্ধকারে আধার রাতে, আধার ঘরে একটু আশার  প্রতিকী ফলক, এ আলোয় কেউ কারো মুখও ভালো করে দেখতে পায় না । ঘরটা বেশ নিরব নিস্তব্দ, রাতের সকল জরতা ও মলিনতা সবটাই যেন, আজ এই ঘরটাতে দখল বাজিতে মেতে উঠেছে। হটাৎ মজু মিয়ার কথা আদান-প্রদান কারি ছোট্ট যন্ত্রটি (মোবাইল) রাতের সব নিরবতাকে ভেঙ্গে দিয়ে ,বেঁজে উঠলো.....টু টু টা টা টি....  মজু মিয়া তখন স্বাভাবিক শক্তি সঞ্ছার করে বড়ই উদ্বেলিত হয়ে , ছোট্ট যন্ত্রটির টু টু টা টা টি... থামানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, এবং সেটা সম্পন্ন করে  নিজের কানের উপর যন্ত্রটি লাগিয়ে, তার গলার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে একটা ইংরেজি শব্দ (হ্যালো)  বলার সাঙ্গে সাঙ্গে অপর প্রান্ত হতে .......
বাজান তোমরা ভালা আছ ?
হ' বাজান আমরা ভালা আছি , অহন তোমার অবস্থা কও্ ।
আমারে পরদিন রাইত বেলা ঔহানে  নামাইছে , রাইতে ঔহানে থাইকা সকাল বেলা অাবার যেহানে কাম করুম সেহানে অাইয়া পড়ছি ।
যাইতে পথে কোন সমস্যা হয়নাই তো ?
না বাজান, ভালা মত আইতে পারছি কোন রহম সমস্যা হয় নাই।
তোমরার কোন্ খবর না পাইয়া খুবই দুঃচিন্তায় আছিলাম , যাক শুকরিয়া অহনে ভালা লাগতাছে।
চিন্তা কইরো না বাজান , অহন তন প্রতিদিন ফোন করুম । মায়ে কই মায়েরে দেও মার লগে কথা কমু । মমিন মায়ের সাথে কথা বলা শুরু করে...
 তুই কেমন আছোছ বাজান?
মা আমি ভালা আছি ,তুমি কেমন আছ ?
আমরাও ভালা আছি ।
আমার লাইগ্যা খুব চিন্তা করতাছিলা বুঝি ?
হ' বাজান , তোমার কথা হুননের লাইগা আমার পরানটা জ্বলতাছিল ।আগে ফোন করনাই ক্যান বাজান?
অহন থাইক্যা তোমারে প্রতিদিন ফোন করুম । কান্না কাটি করবানা কইলাম ,তুমি কান্না কাটি করলে আমার ভালা লাগবো কও ? আমি কাজ কমে কি মন লাগাইতে পারুম, তোমরা এমন করলে পরে আমি এইহানে থকবার পারুম ।
কি করুম বাজান মনডারে যে মানাইতাম পারি না কান্না আইয়া পরে ।
মা হুন আমি ভালা আছি এইহানে । অহন তুমি কান্নাকাটি না কইরা দোয়া করবা উপরওয়লা যেন কোন বালা মুছিবত না দেয় । যেন শরীল ভালা থাকে কাজ কাম করবার পারি ।
হ' বাজান আমিতো উপরওয়ালার কাছে সব সময় হেইডাই দোয়াই চাই ,যেন তোমরার দুই ভাই রে হগল বালা মুছিবত থন রক্ষা করে।
এ ভাবে চলতে থাকে মমিনের সাথে মমিনের মায়ের কথা । ঐই দিন থেকে ছেলে সাথে কথা বলার জন্য আর তেমন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় নাই মমিনের মায়ের । এরপর হত নিয়মিত ছেলের কাজ কর্ম খাওয়া দাওয়া সহ সব খুটি নাটি বিষয়েয় খবর তার কর্ণ গভিরে প্রবেশ করেছিল, মজু মিয়ার ঐ কথার বাক্সটির মাধ্যমে । সুদুর লাইবেরিয়া হতে মমিন তার বাবা-মার সাথে এই ছোট্ট যন্ত্রটির মাধ্যমে সকল প্রকার কথা আদান প্রদান করেন । 
  
                                              ষষ্ঠ অংশ

এভাবে চলতে থাকে মমিনের দৈনিক দিনের কাজ কর্ম ও কর্মের সফল উদ্দেশ্যের পথে অবিরাম ছন্দে সামনে চলা । ইতোমধ্যে মমিন পরবাসে তিনটি বছর অতিবাহিত করে ফেলেছিল বেশ সফলতার ছোট ছোট সিঁড়ি মাড়িয়ে । সফলতা বলতে তার উদ্দেশ্য ছিল বিদেশে গিয়ে কাজ করে টাকা জমানো । এবং ঔ জমানো টাকা দিয়ে দেশে কিছু একটা করে, দেশের অতিপরিচিত চেনা-জানা পথ-ঘাট, গাছ-পালা ,বাবা-মা্‌ আত্নীয়-সজ্বন, ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে থেকে পারি দিবেন জীবন সংগ্রামের অসম্পূন্ন সময় টুকু । বিগত তিনটি বছরে তার প্রথম লক্ষ্যটির শতভাগ পূরন হয়েছে বৈকি । তাইতো এখন দ্বিতূীয় লক্ষ্যটির দিকে অগ্রসর হওয়ার পালা ..................
         

                                                পরবাসে আর নয় মায়ের কোলে ফিরতে হয়
                                                           ডাক পড়েছে মায়ের মমতার,
                                                             শত বাধা ভাঙ্গবো এবার। 
                                                 স্বদেশের সমিরন (বাতাস) ডাকিতেছে
                                                              যেন  দু-হাত বাড়িয়ে
                                                               লতা পাতা নাড়িয়ে ।
                                                  শিশ দিয়ে শিশিরে, জোনাকির নিশিরে
                                                               পাকালির হাঁক
                                                               দিয়ে যায় ডাক ।
                                                  স্বদেশের মাটি হীরার মতো খাটি
                                                               মিশে আছে সাথে ,
                                                               মায়ের মমতা তাতে ।
                                                    জুড়ায় যাহাতে প্রাণ,আমার দেশের গান
                                                               সবুজ শ্যামলী বেশ
                                                               আমার বাংলাদেশ ।

                                                                        (বিপু বর্মনের,"স্বদেশ আমার " কবিতার অংশো বিশেষ )     
  


অবশেষে এলো সেই আনন্দঘন মুহূর্ত , এ যেন এক অনাবিল আনন্দ উচ্ছাস, স্বপনীল উদাসীনতায় ভেসে চলা সুখের জোয়ারে , পুলকিত হওয়া মন প্রিয়জনের আলিঙ্গনের অপেক্ষায় । মমিনের যেন দেশের টানে এখন মন প্রাণ ব্যকুল, ঘুমের ঘোরে কতবার যে দেশে আসা হয়েছে গত তিনটি বছরে, কিন্তু ঘোর কাটলে মনে কষ্ট নিয়ে থাকতে হত মমিনকে । 
এবার আর এমনটা হবার সুযোগ নাই, সে স্বশরীরে এবার আসবে বাবা-মা  ভাই-বন্ধু , নিজ গ্রাম, গ্রামের মানুষ, দেশ দেশের স্বজনদের  কাছে। সকলের সাথে দেখা হবে এই ভেবে মমিনের ভিতরে ভিতরে সে যে কি মহা আনন্দ । এটা আর কাকে বুঝাবে সে, শুনার মতো কেউ তো নাই, ভিতরে ভিতরে খুশিটা তাই লাফা-লাফি করছে আর মমিন সেটা বেশ ভালই উপভোগ করছে, তাইতো মনের ভিতরটা বড়ই আলগা হয়েছে মায়ের মমতার জন্য ।
বলতে গেলে তার দেহটা সুদুর লাইবেরিয়ায় থাকলেও মনটা তার মায়ের কাছে চলে এসেছিল । শেষে মমিন তার মন ছাড়া শরীরটা নিয়েই যে দেশের উদ্দেশ্য রওনা হলো, এতে মমিনের খারাপ তো লাগছেই না বরং নিজেকে বেশ ফুরফুরে অনুভব করছেন তিনি।
আর মাত্র কয়েক ঘন্টা তার পর লাইবেরিয়া হতে আকাশ পথে ঢাকা বিমান বন্দরে, তার পর নিজ গ্রাম, তারপর ভাবতেই যেন, মমিনের সব দুঃখ কষ্ট একটি সস্থির নিঃশ্বাসের সাথে সেই সুদুর লাইবেরিয়াতে ছুড়ে ফেলে দিলেন । অতপর মমিনের মনে মনে অনুভব হতে থাকলো ....শুধুই প্রশান্তি আর প্রশান্তি। একটু পর মমিন বিমান বন্দরে প্রবেশ করবেন। তারপর আর মা-বাবার সাথে যোগাযোগ হবেনা, এই ভেবে তার মায়ের কাছে  প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য ফোন দিলেন..
মা আমি একটু পরই বিমানে উঠুম ।
নামবা কোন্ সময় বাজান ?
কাল ভোর রাইতে । মা বাজান কোন হানে ?  
অহনে তো এইহানে আছিল, কই গেল দেখতাছি.
হুন, মা অহনে আমার সময় নাই। বাজানরে কইয়া দিও ভাইজান সহ কাল বেয়ানে (সকালে) যেন বিমান বন্দরে থাহে।
ঠিক আছে, তাই কমুনে তোমার বাজান রে। 
তয় অহনে রাহি (রাখি)
খুশির চোটে মমিন ফোনও কথা বলতে পারতেছিল না মায়ের সঙ্গে ।

                                      
                                          সপ্তম অংশ 
 
তাইতো  তরিঘরি করে ফোনটা কেটে দিয়ে জিনিস পত্র বুক করে, দ্বিতীয় গেট দিয়ে যাবার সময় লক্ষ করলেন, কয়েক জন সাদা পোশাক (ইউনিফর্ম) পরা লোক, তাদের মুখে মাস্ক, হাত ও পায়ে মুজা পরিহিত। তারা বিমানের যাত্রীদের এক এক করে কি যেন পরিক্ষা করছেন । 
আরো নিকটে গিয়ে বিষয়টি বুঝতে পারলেন, এই সাদা পোশাক পরিহিত লোকগুলি এই খানকার দায়িত্বরত ডাক্তার। কি যেন ? একটা নতুন রোগ আবির্ভাব হয়েছে "ইবোলা" ডাক্তাররা ওটারি পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতাছেন । এটা সম্পর্কে মমিন একটু একটু জেনেছে, তার এক সহকর্মীর কাছ থেকে । সে জানতে পেরেছিল, এটা এক ধরনের ভাইরাস এবং এটা নাকি মারাত্মক ছোঁয়াছে রোগ, এটার জীবাণু নাকি খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে, আশে-পাশের সবার মধ্যে । এমন কি এই জীবাণুতে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির শরীর হতে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে যায় । 
এই রোগটি নাকি এ দেশে ভালো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে । তাই এই রোগিদের সনাক্ত করার জন্য ডাক্তারি ক্যাম্প বসেছে এখানে । আন্তরজার্তিক মানব অধিকার সংস্থা হতে বলে দেয়া হয়েছে যে, ইবোলা সংক্রোমিত এলাকা গুলো যেন নিজ তদারকীতে আগত ও বহিরাগত লোকদের পরিক্ষা নিরিক্ষা করবে,  যাতে এই রোগ দ্রুত অন্য জায়গায় ছড়িয়ে না পড়ে । আর তাই এই বিশেষ ব্যবস্থা এখানে গ্রহন করা হয়েছে।
মমিনের পরিক্ষা-নিরিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব নেওয়া হয়েছে। আর তাকে নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে অন্য যাত্রীদের সাথে, পরিক্ষা শেষে ছাড়পত্র মিললেই যেতে পারবেন এখান থেকে । মমিন বেশ অস্থির মনে ভাবে, কতক্ষনে নির্দেশ আসবে তার অপেক্ষা,  আর ওখানেই বসে মমিন সৃষ্টি কর্তার নিকট মনে মনে প্রাথনা করলো যে "যারা এই রোগে আক্রান্ত তাদের যেন মুক্তি দান করেন "।
মোটা-মোটি সবাইকে গেট পার হবার নির্দেশ দিলেও, মমিন সহ আরো তিন-চারজন কে পাশের একটি রুমে রাখা হলো । এবং ওদের সবার কাছ থেকে পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে নিলেন প্রশাসনের একজন । মমিন তখনো কিছুই বুঝতে পারে নাই । কি হইতাছে তার সাথে? কি ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে? কিছু বুঝে উঠার আগে ঐ পরিক্ষক দলের একজন বলে গেলেন আপনারা চাইলে ফ্লাইট বাতিল করে, সন্দেহ মুক্ত হয়ে পরে অন্য ফ্লাইটে যেতে পারেন । 
ভিন্ন ভাষা ভাষির হওয়ায় আলোচনাতে ও সমস্যা হইতাছিল। তারপরও তারা সিদ্ধান্ত নিল সবাই সন্দেহ মুক্ত হয়েই এখান থেকে যাবেন । কিছুক্ষন পর আর একটা মেডিকেল টিম এলো এবং তারা নিবির ভাবে পরিক্ষা-নিরিক্ষা শুরু করলেন, একটি আলাদা রুমে নিরিবিলি পরিবেশে  দীর্ঘ তিন ঘন্টা পর্যাবেক্ষনের পর যে সংবাদ আসলো, সে সংবাদ টা শোনার জন্য মমিন প্রস্তুত ছিলেন না ! সে কেন ? কেউ সেখানকার প্রস্তুত ছিলনা সেই সংবাদ শোনার জন্য । নিরবে নিরবে যে  ঐ ঘাতক ব্যাধি "ইবোলা" বাসা বেধেছে মমিনের শরীরে । এতক্ষনে মমিন যেন চেতন ফিরে পেল তাকে নিয়ে এই যে টানা হেছড়া তার অর্থ কি ? সে যে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত, এটা কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না । মমিনের এখন কেন যেন নিজের ভিতরে ভিতরে বেশ ভয় লাগা শুরু হয়েছে । এইতো কিছুক্ষন আগেও ইবোলার চিন্তা তার মাথায় ছিলোনা, কতটা নির্ভার্ ছিলেন বাবা-মা আর ভাইজানের চিন্তায় । 
হায়রে ইবোলা ! মন ছাড়া দেহটাতেই বীজ বুনছো কিসের আসায় ? সময়ের সাথে সাথে মমিনের অস্থিরতা বাড়তে লাগলো, সাহস হারাতে শুরু করল সে । 

                                               শেষ অংশ 
শরীরের লোম-গুলো জাগ্রত হতে লাগলো, কি করবে মমিন ! বুঝে উঠতে পারেনা । বজ্রপতিত প্রকৃতির মতো মাথাটা যে এলো-মেলো,  কি হলো ! কি করবো, কি করবো ? ঘোর কাটেনা মমিনের । একজন নার্স এসে তাকে বলে গেল..
আপনি দেশে যেতে চাইলে স্পেশাল কেয়ারে দেশে যেতে হবে, আপনি কি যেতে চান ? মমিন হঠাৎ করে প্রশ্ন করে বলল
আমি কি করবো বুঝতে পারছি না ।
বলে হু হু করে কেঁদে ফেলল, মমিনের কান্না শুনে নার্সটা কিছুক্ষন পাশে থেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল । কিন্তু মমিনের কান্না কিছুতেই থামলো না । এ কান্না থামবে না ভেবে নার্স নিঃশব্দে চলে গেলেন । কিছু ক্ষন পর আবার নার্স আসলেন একই প্রশ্ন
কি করবেন ভেবেছেন ?
জবাব কিছুই এলোনা ফোঁস-ফোঁসানি ছাড়া ।
শুনুন আপনি দেশে গেলে শুধু আপনি যাবেন না সাথে বহন করে নিয়ে যেতে হবে, এই ভয়াবহ ইবোলা ভাইরাস । যেটা আপনার দেশ ও পরিবারের সবার জন্য মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে । আমাদের এই মেডিকেলে প্রায় ৬৫ জন নার্স ও ১৮ জন ডাক্তার ছিলেন বেশির ভাগ পালিয়ে যায় জীবন বাঁচাতে ।আর আমরা চার জন নার্স ও তিন জন ডাক্তার ছাড়া, বাকিরা এই ইবোলা রোগীদের চিকিৎসা ও সেবা করতে গিয়ে আত্নত্যাগ করেছে । আর আমরা তাদের কে অনুসরণ করবো  এটা নিশ্চিত ! কারন এই রোগের একটা রোগীকে ও আমরা বাছিয়ে রাখতে পারি নাই । হয়তো আপনাকে ও বাঁচাতে পারবোনা । এটা আমাদের দায়িত্ব তাই একজন মানুষ হিসেবে, একজন নার্স হিসেবে আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত । যেটা আমার স্বামী ডাক্তার হিসেবে করে গিয়াছে নিজের জীবন ত্যাগের মাধ্যেমে । তিনি এখান কার কর্তব্যরত ডাক্তার ছিলেন এবং গত ছয় দিন আগে আমার হাতের উপর উনার মৃত্য হয় । বলতে বলতে নার্স সেফি ব্রাউনার চোখের পাতা গুলো ছল ছল করে উঠলো । গাল গড়িয়ে পড়ল কয়েক পোটা অশ্রু, সেটা মুছতে মুছতে বেড়িয়ে গেলেন সেফি ।
মমিন কে আরেক বার হতবাক হতে হল । এরা কি ভাবে নিজের জীবন কে উৎসর্গ করে ! কি ভাবে আপনজনের আত্নাহুতির শোক কে সাহসে পরিনত করে । ক্ষনিক সময়ের জন্য হলেও নিজেকে ভুলেই যান মমিন । নার্স সেফির কথা শুনে মৃত্যু কে নিশ্চিত জেনেও কি এক পরম আনন্দ তার ।
হায়রে ইবোলা ! হায়রে সেফি !
নার্স একটি ফর্ম হাতে নিয়ে মমিনের কাছে এলেন, সাথে তার পাসপোর্ট ভিসা দেখিয়ে বললো এগুলো আপনার তো ?
হ্যাঁ আমার ।
এটা পুরন করেন।
এটা কি ?
এটা আপনার চিকিৎসা এবং  মৃত্যুর পর আপনার লাশ দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া পত্র । নিন এটা পুরন করুন ।
মমিন চিকিৎসা নেয়ার আবেদন ফর্মটি পুরন করলেন । কিন্তু বাকি ফর্মটি পুরন করলেন না !
অবশ্য এটারও যথাযথ কারন ছিল মমিনের কাছে, তার ভিতরে বাসা বাধা এই সর্বনাশা ইবোলা ভাইরাস যেন, দেশের মাটির বুকে এসে বাসা বাধতে না পারে । ইবোলা গোপনে গোপনে দখল করে নিয়েছিল মমিনের দেহ, তাই নিজের দেহটাও ইবোলার তরে সপে দিয়ে, ইবোলা মুক্ত রাখলেন নিজ পরিবার, স্বজন, দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে। যে দেশের প্রকৃতির সব কিছুর সাথে তার ছিল আত্নার নিবির সম্পর্ক, যে দেশে আসার জন্য মন প্রাণ ব্যকুল হয়েছিল মমিনের । সে দেশকে ইবোলা মুক্ত রাখতে, নিজেই থেকে গেলেন পরবাসে । আপন জনের মায়ার টানে যে মনটা বার বার অশান্ত হয়ে উঠেছিল । সেই অবুঝ মনটাকে চিরশান্ত করে দিয়ে নিজেই রয়ে গেলেন সেই দূর প্রবাসে ।
মমিন কে সম্মান জানানো যায় যত চাই, তাকে বিদায় জানানো যায় না । বীর যারা তারা স্মরণীয়, মমিন তো এ দেশের বীর সন্তান । নিরবে তুমি করে গেলে দেশ ও দশের জন্য ইবোলা যুদ্দ , জানতে পারেনি তোমার মা, বাবা, ভাই স্বজন , এমনকি দেশের কোন মানুষ ।
যুদ্দ শেষে বীর বেশে ফিরতে পারোনি যদিও ভিন দেশ হতে । অলিখিত বিজয় উপহার হিসাবে পাঠিয়ে দিয়েছো ১৭ (সতের) কোটির অধিক প্রানের ইবোলা মুক্তি ।



                                                
সম্পাদনা
মামুন,

                                                 



    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন