মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকুন হৃদয় সুস্থ রাখুন। বিভিন্ন গবেষনার ফলে প্রমানিত হয়েছে, মানসিক চাপ হৃদযন্ত্রের ক্ষতি সাধন করে।
নিউ
ইয়র্কের রচেস্টার মেডিকল সেন্টারের সেন্টার ফর মাইন্ড-বিডি রিসার্চ’য়ের
মনোরোগবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক ড. ক্যাথি হেফনার বলেন “বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত
বিশ্লেষণ করে জানা গেছে— দুশ্চিন্তা, স্বল্পপুষ্টির খাবার খাওয়া বা ব্যায়াম
করার অনীহার ফলে যেসব ঝুঁকি থেকে মানসিক চাপের ফলেও সৃষ্ট সমস্যাগুলো
ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে”
সম্প্রতি
একটি স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার কিছু উপায়
জানানো হয়। যেগুলো মানসিক চাপ কমিয়ে হৃদয়ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন
ড.
হেফনার বলেন “ইয়োগা, ধ্যান কিংবা তাই-চি ইত্যাদি শরীরে দুশ্চিন্তা
সৃষ্টিকারী হরমোনের পরিমাণ কমিয়ে ফেলে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বাড়িয়ে দেয়।”
একটি
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যারা নিয়মিত ইয়োগা করেন তারা তুলনামূলক কম শারীরিক
সমস্যা বা প্রদাহে ভোগেন। বিভিন্ন দুরারোগ্য শারীরিক সমস্যার মধ্যে
গা-ব্যথা অন্যতম। পরে যা থেকে হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে।
এ
সম্পর্কে ‘টেক্সাস এঅ্যান্ডএম হেল্থ সায়েন্স সেন্টার কলেজ অফ মেডিসিন’য়ের
সহকারী অধ্যাপক জন সিমন্স জুনিয়র বলেন “নিয়মিত দিনের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে
অন্যসব ব্যস্ততার কথা ভুলে একান্ত মনে বিশ্রাম শরীরের জন্য ভালো ফল বয়ে
আনে।”
বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান
সবসময় একাকী থাকা মানসিক স্বাস্থ্যে পাশাপাশি হৃদযন্ত্রেরও ক্ষতি করতে পারে। এমনকি কখনও হৃদরোগ ধরা না পড়লেও ক্ষতির আশংকা থেকেই যায়।
একটি
গবেষনায় দেখা গেছে মানসিক চাপ থেকে সাধারণত মহিলারা একধরনের কণ্ঠনালীর
প্রদাহ, হৃদপিণ্ডসক্রান্ত বুকের ব্যাথা এবং অন্যান্য সমস্যায় ভোগেন। বিশেষ
করে তারা যখন হার্ট-অ্যাটাকের পরে সময়টায় পরিবার বা সমাজ থেকে পর্যাপ্ত
মানসিক সহায়তা পাননা। তাই একাকী ঘরে বসে না থেকে আজই বন্ধুদের সঙ্গে বের
হয়ে পড়ুন। তবে এক্ষেত্রে প্রকৃত বন্ধু নির্বাচনে সচেতন হতে হবে।
হেফনার এর মতে “আপনার বন্ধুরা যদি স্বার্থপর হয় তবে অনেক বন্ধু থাকলেও তা খুব একটা উপকারী হবে না।”
নির্ভুল হওয়ার চিন্তা বাদ দিন
যারা সাধারনণত “টাইপ এ” চরিত্রের মানে সবসময় শুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী হতে চান তারাই মূলত হৃদরোগে বেশি ভোগেন।
হেফনারের মতে এ ধরনের অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে মনোভাব শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিচরিত্রে শত্রুতার মনোভাব তৈরি করে।
তিনি
বলেন “টাইপ এ চরিত্রের পেছনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব
মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে এধরনের মনোভাব ব্যক্তিমনে
অন্যদের প্রতি প্রবল বিদ্বেষ তৈরি করে।”
গবেষনায়
দেখা গেছে, শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব উচ্চ রক্তচাপ এবং মুটিয়ে যাওয়ার মূল কারণ
যা পরে হৃদরোগ ডেকে আনে। তাই সবসময় ভালো চিন্তা করুন এবং সবার সঙ্গে ভালো
ব্যবহার করুন। কেননা আশাবাদী মনোভাব আপনার হ্রদযন্ত্র রাখবে সুরক্ষিত এবং
বিপদমুক্ত।
ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলুন
মনের
মধ্যে ক্ষোভ জমা করে রাখার অভ্যাস কখনোই হৃদযন্ত্রের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে
না। গবেষনায় দেখা গিয়েছে ক্ষমা করার পরিবর্তে ক্ষোভ জমা করে রাখলে মানসিক
চাপ বেড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে হৃদ্ররোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ে।
ডক্টর
সিমন্স বলেন “আপনি ভাবতেই পারবেন না মনের মধ্যে ক্ষোভ জমা থাকলে তা কত
দ্রুত এবং দীর্ঘ সময় ধরে শরীরের ক্ষতি সাধন করে। তাই নিজের ঘাঁড় থেকে এই
আপদ নামিয়ে মানসিকভাবে সুস্থ থাকুন সবসসময়।”
এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ক্যথি হেফনার ক্ষমাশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এর ফলে সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় হবে যা সুরক্ষিত রাখবে হৃদযন্ত্র।
প্রাণ খুলে হাসুন
২০০৫
সালে পরিচালিত গবেষণায় জানা যায় সবসময় গম্ভীর থাকার বদলে প্রাণ খুলে হাসলে
শতকরা বিশভাগ বেশি ক্যালরি পোড়ানো যায়। তাই প্রাণ খুলে হাসুন।
প্রাপ্তবয়স্ক
কিছু মানুষকে নিয়মিত হাস্যকর এবং তুলনামুলক গম্ভীর চলচ্চিত্র দেখানোর পর
গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে আসেন। আর নিয়মিত ক্যালরি পোড়ানোর মাধ্যমে স্থুলতার
হাত থেকে বাঁচা যায় যা কিনা দীর্ঘ সময় ধরে হৃদযন্ত্র সুরক্ষিত রাখার ভালো
একটি উপায়।
নিয়মিত
আমোদ-প্রমোদ হৃদস্পন্দনের হার বাড়িয়ে দেয়। ২০১০ সালে প্রকাশিত আমেরিকান
জার্নাল অফ কার্ডিওলজি’র তথ্যানুসারে, হাসি ঠাট্টার ফলে দেহের সংবহনতন্ত্র
বা বিভিন্ন নালীর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই ঠোঁটের কোণে সবসময় এক চিলতে
হাসি রাখুন কিংবা পারলে মন খুলে হাসুন। আপনি যত বেশি হাসবেন, তত বেশি ক্যালরি পুড়বে এবং হৃদযন্ত্র হবে শক্তিশালী।
অতিরিক্ত মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন
অতিরিক্ত মদ্যপান দেহে ট্রাইগ্লিসারিনের এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হৃদপিণ্ড অকার্যকর করে দিতে পারে।
অন্যদিকে
নিয়ন্ত্রিত মদ্যপান বরং দেহকে হৃদরোগ থেকে দূরে রাখে। তবে এক্ষেত্রে
নিয়ন্ত্রিত মদ্যপান বলতে পুরুষদের জন্য দিনে বড়জোর দু’গ্লাস এবং মহিলাদের
জন্য দিনে খুব বেশি হলে এক গ্লাস বোঝায়।
এ ব্যাপারে ডক্টর সিমন্স সতর্ক করে দিয়ে জানান, যারা মদ পান করেন না তাদের জন্য এটা কখনোই মদ পান শুরু করার কারণ হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, “তবে যদি এক গ্লাস ওয়াইন খাওয়ার নিশ্চয়তা চান তবে তা খেতে পারেন নিশ্চিন্তে।”
ক্যাফেইন নেওয়া কমিয়ে দিন
ক্যাফেইন
খুব দ্রুত আপনার ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তুলে এবং মানসিক চাপ বর্ধক হরমোনের
পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এটা তখনই ভালো যদি আপনি কোনও হিংস্র বাঘের মুখে
পড়েন। তবে সামান্য কারণ যেমন ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ার ফলে যদি এমন হয় তবে
তা চিন্তার কারণ বৈকি। মানসিক চাপ বাড়ানোর হরমোনের নিঃসরণের ফলে শরীরব্যথা
শুরু হয়। তাই ঘন ঘন চা-কফি খাওয়ার অভ্যেস ছাড়ুন। কেননা এসবে প্রচুর পরিমাণে
ক্যাফেইন থাকে।
এমনকি
জিরো-ক্যালরি বা চিনিহীন বলে বাজারজাত করা কোমল পানীয় থেকেও নিজেকে দূরে
রাখুন কেননা গবেষনায় দেখা গিয়েছে, এ ধরনের কোমল পানীয় পান করলে ডায়াবেটিস
এবং হৃদরোগের আশঙ্কা থাকে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন
অতিরিক্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের প্রতি অতিরিক্ত আবেগী মনোভাব দূর করা উচিত।
উদাহরনস্বরূপ, গবেষকদের মতে প্রিয় ফুটবল দলের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেড়ে যায়।
তাই তুচ্ছ কারণে উত্তেজিত হবেন না। কারণ জীবনের মূল্য এর চেয়ে ঢের বেশি।
সঠিক খাবার খান
লাল
মাংস এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য কম পরিমাণে এবং শাক-সবজি, ফল, মাছ এবং
শস্যদানা বেশি পরিমাণে খাওয়ার অভ্যাস শুধু ওজনই নিয়ন্ত্রেণে রাখবে না
পাশাপাশি হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ
নিয়ন্ত্রণে থাকবে আর হঠাৎ বিপদের হাত থেকে দূরে থাকা যাবে।
এ
সম্পর্কে ডক্টর সিমন্স বলেন “সুষম খাদ্য গ্রহনের মাধ্যমে শরীর সারাদিন
স্থিতিশীল থাকবে। ফলে একেক সময় একেক রকম বোধ করবেন না এবং কখনও
দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগবেন না।”
তাছাড়া হৃদরোগ হওয়ার অন্যতম কারণ বহুমুত্র রোগ থেকে দূরে রাখে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।
অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাহায্য নিন
মানসিক
অবসাদের ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় এবং আয়ু কমে যেতে
পারে। অবসাদে ভুগলে মনোরোগবিদের পরামর্শ অনুযায়ী সাইকোথ্যারাপি নিন।
দ্য
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক’য়ের মতে মানসিক অবসাদনাশক নানান রকম ওষুধ রয়েছে যা
দেহে রক্তচাপ বাড়তে দেয় না। তবে এসব ওষুধ গ্রহণের আগে অবশ্যই ডাক্তারের
পরামর্শ নিতে হবে এবং ব্যবহারবিধি জানতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম
বর্তমানে
মানুষদের মধ্যে না ঘুমিয়ে থাকার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সুস্থ থাকতে হলে ছয়
থেকে আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। এক্ষেত্রে সময়ের চেয়ে কতটা নিশ্চিন্তে ঘুমোনো
গেলো তা বেশি গুরুত্বপূর্ন।
‘Sleep
apnea’ এমন একটি অবস্থা যার ফলে ব্যক্তি নিঃশ্বাসে অসুবিধার কারণে ঘুম
থেকে পর্যায়ক্রমে জেগে ওঠে। যারা এই সমস্যায় ভোগেন তাদের হৃদরোগ হওয়ার
আশঙ্কা থাকে।
যে
ব্যক্তি রাতে পর্যাপ্ত ঘুমোতে পারেন তার ঘুমচক্র স্বাভাবিকভাবে পূর্ণ হয়
না। আর রাতের বেলা স্বাভাবিকভাবেই রক্তচাপ কম থাকে এবং শরীরে হরমোন কম
উৎপন্ন হয়। যা থেকে হাইপারটেনশন এবং হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বেশি করে পরিশ্রম করুন
রোগমুক্ত
থাকতে চান? তাহলে নিয়মিত হাঁটা, দৌঁড়ানো, সাঁতার কাটা কিংবা নাচের অভ্যাস
করুন। এসব কর্মকাণ্ড শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ রাখবে এবং ডায়বেটিস
কিংবা হৃদরোগ থেকে দূরে রাখবে। কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে মানসিক অবসাদ থেকেও
মুক্তি পাওয়া যায়। একের পর এক গবেষনায় দেখা গিয়েছে, বাগান করার মতো কাজের
মাধ্যমেও অনেক সুফল পাওয়া যায়। কারণ তা হৃদপিণ্ডকে সক্রিয় রাখে এবং রক্ত
চলাচলে সাহায্য করে।
দ্য
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’য়ের মতে দৈনিক বা সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন
অন্তত ৩০ মিনিট এ ধরনের পরিশ্রম করা উচিত। তবে কোন ব্যায়াম দিয়ে শুরু করবেন
তা ঠিক করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। লিংক সুত্রঃ এইখান থেকে সংগৃহীত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন