ঘুমের সমস্যা ও প্রতিকার
ডা. জিল্লুর কামালঘুম আমাদের জীবনেরই অংশ। সজাগ থাকার পর ঘুম আসবে এটিই নিয়ম। মাঝে মধ্যে ঘুমে ব্যাঘাত সবারই হয় বিশেষ দুশ্চিন্তা বা মনোকষ্টের জন্য কয়েক দিন ঘুম না হওয়ার পর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমরা স্বাভাবিক ঘুমে ফিরে যাই। কিন্তু কখনো যদি ঘুম না হওয়া ব্যাপারটা দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকে তা হলে আমরা মুষড়ে পড়ি, ডাক্তারের কাছে দৌড়াই। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘুম না হওয়ার কারণগুলো খুব সাধারণ ও প্রতিকারযোগ্য।
ঘুমের রকমফের : রাতের বিভিন্ন সময় আমরা বিভিন্ন প্রকারের ঘুম ঘুমাই। এসব ধরনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধরন হলো দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন ঘুম। এ ধরনের ঘুম এই আসে এই যায়। আমাদের মোট ঘুমের এক-পঞ্চমাংশ এ ধরনের ঘুম। এ ঘুমের আমাদের মস্তিষ্ক খুব সচল থাকে, চোখ দু’টি এপাশে ওপাশে দ্রুত সঞ্চালিত হয় এবং আমরা স্বপ্ন দেখি।
ঘুমের বাকি চার-পঞ্চমাংশ দ্রুত চক্ষু সঞ্চালনবিহীন ঘুম। এ ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক থাকে খুব নিথর। এ সময় বিভিন্ন হরমোন নি:সৃত হয়ে রক্তে মেশে। সারা দিনের কাজে ক্ষয়প্রাপ্ত শরীরের বিভিন্ন অংশ সারিয়ে তোলে এসব হরমোন।
কতটুকু ঘুম দরকার?
আমরা কতটুকু ঘুমাব তা মূলত নির্ভর করে আমাদের বয়স ও পরিশ্রমের মাত্রার ওপর। ছোট্ট শিশুরা দিনে প্রায় ১৭ ঘন্টা ঘুমায়। কিন্তু একটু বড় শিশুরা রাতে ৯ থেকে ১০ ঘন্টা ঘুমায়। রাতে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানোই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যথেষ্ট। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘুমের প্রয়োজন কিছু কমে যায়। তা ছাড়া দিনে ঘুমালে রাতে ঘুম আসবে না এটিই স্বাভাবিক।
ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ঘুমের পরিমাণে বেশ তফাত দেখা যায়। কেউ কেউ রাতে মাত্র ৩ ঘন্টা ঘুমিয়েই চলতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই তা পারে না। ক’দিন না ঘুমালে বেশির ভাগ মানুষই সারাক্ষণ ঘুম ঘুম বোধ করে, কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে পারে না।
ঘুম না হলে আপনি কষ্ট পাবেন এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু মাঝে মধ্যে দু-এক রাত ঘুম না এলে অতি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দু-এক রাত ঘুম না হলে তা আমাদের শারীরিক বা মানসিক স্বাস্খ্যের খুব বড় ক্ষতি করে না। তবে যেকোনো কারণে লাগাতার বেশ কিছু দিন ঘুম না হলে সারাক্ষণ ঘুম ঘুম লাগে এবং কোনো কিছুতে মনোযোগ দেয়া যায় না, সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দেয় আর বিষণíবোধ হয়। এ সময়ে গাড়ি চালানো বা ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করা খুব বড় বিপদের কারণ হতে পারে। গাড়ি চালানোর সময় ক্ষণিকের জন্য ড্রাইভারের ঘুমিয়ে পড়া অনেক সড়ক দুর্ঘটনার কারণ।
অনিদ্রা
যাদের ঘুমের সমস্যা আছে তারা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে তাদের যথেষ্ট সময় ধরে ঘুম হচ্ছে না বা ঘুমের তৃপ্তি হচ্ছে না। যদিও সময় হিসাব করলে দেখা যাবে ঘন্টার হিসেবে তারা বেশ অনেকক্ষণ ঘুমাচ্ছেন। তবুও এ অভিযোগের কারণ ঘুম ভেঙে ভেঙে যাওয়া। ঘুমের মধ্যে জেগে যাওয়ার অল্প সময়টুকু অনেক লম্বা মনে হয়।
প্রতি দিনের অনেক সাধারণ বিষয় আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যেমন হয়তো শোবার ঘরটায় আওয়াজ বেশি, ঘরের তাপমাত্রা বেশি বা কম, বিছানা আরামদায়ক নয়, ঘুমের জন্য নির্দিষ্ট রুটিন মানা হচ্ছে না বা যথেষ্ট শারীরিক পরিশ্রম করা হচ্ছে না। রাতে বেশি খেলে ঘুম আসতে চায় না, আবার পেটে বেশি খিদে থাকলে ঘুম ভেঙে যায়। সিগারেট, অ্যালকোহল ও ক্যাফিনযুক্ত খাবার যেমন চা, কফি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। শরীরের কোথাও ব্যথা বা গায়ে জ্বর থাকলেও ঘুম ঠিকমতো হয় না। তবে যদি দীর্ঘ দিন ধরে ঘুমের সমস্যা চলতেই থাকে তা হলে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ তা বেশির ভাগ সময়ই মারাত্মক কিছুর ইঙ্গিত দেয়, হতে পারে তা ব্যক্তিগত বা কর্মক্ষেত্রের কোনো ইমোশনাল সমস্যা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা বিষণíতা।
ওষুধে কাজ হয়?
অনেকেই ঘুমের সমস্যার জন্য ঘুমের বড়ি খান। দীর্ঘ দিন একটানা ঘুমের বড়ি খাওয়া উচিত না। এতে আপনি অবসন্ন বোধ করবেন, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে এবং ধীরে ধীরে বড়ির পরিমাণ না বাড়ালে আগের মতো ভালো ঘুম হবে না। ফলে আপনি বড়ির ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবেন। তাই ঘুমের বড়ি যত কম সময় ধরে ব্যবহার করা যায় ততই ভালো। ঘুমের বড়ির মতো অ্যালকোহলও ঘুমের সমস্যা করে। তাই এ দু’টিকে পরিহার করুন। ওজন কমানোর জন্য ব্যবহৃত ওষুধ, বিভিন্ন মাদকদ্রব্য যেমন হেরোইন, কোকেন, এমফিটামিন ইত্যাদিও ঘুমের ব্যাঘাত করে। ঘুমের সমস্যা সমাধানের জন্য অনিদ্রার মূল কারণের চিকিৎসা করতে হবে।
? একটানা দীর্ঘ দিন নির্ঘূম কাটাবেন না। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান এবং নির্দিষ্ট সময়ে বিছানা ছেড়ে উঠুন তা আপনি ক্লান্ত থাকেন বা না থাকেন।
? শোবার ঘর যথেষ্ট আরামদায়ক কি না নিশ্চিত হোন। ঘরে যেন বেশি আওয়াজ, গরম বা ঠাণ্ডা না থাকে।
? বিছানা আরামদায়ক কি না নিশ্চিত হন। বিছানা বেশি শক্ত হলে কোমর ও কাঁধে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, বেশি নরম হলে শরীর বেশি ডেবে যায়, ফলে ঘুম ভালো হয় না।
? প্রতি দিন শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করুন। অনেকেই নিয়মিত ব্যায়াম না করে হঠাৎ হঠাৎ অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যায়াম করে। এটি ঠিক নয়।
? চা বা কফি অ্যালকোহল পান কমিয়ে দিন, সম্ভব হলে একেবারে বìধ করে দিন। বিশেষত বিকেলের পর চা বা কফি খাবেন না। এ সময় দুগ্ধজাত পানীয় খেতে পারেন।
? বেশি রাত করে খাবেন না। প্রথম রাতের দিকেই খাবার সেরে নিন। রাতে অতিরিক্ত পরিমাণে খাবেন না।
? রাতে ঘুম ভালো না হলে তা পুশিয়ে নেয়ার জন্য পরদিন দিনে ঘুমাতে ইচ্ছে করতে পারে। এটি করবেন না, তাহলে আবার রাতে ঘুমের সমস্যা হবে। রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান।
? ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছু সময় রিলাক্স মুডে থাকুন। হালকা বই পড়ুন, গান শুনুন।
? কোনো বিষয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকলে ঘুম আসতে চায় না। এ ক্ষেত্রে একটি কাগজে আপনার দুশ্চিন্তার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে লিখে ফেলুন। বিষয়টি সম্পর্কে আপনি কী করতে চাচ্ছেন এবং কখন থেকে তা করবেন স্পষ্ট করে লিখুন। বিষয়টি সমাধানযোগ্য না হলে এর পরিণতি কী কী তা লিখুন, কোন পরিণতি আপনার জন্য ‘মন্দের ভালো’ হবে তা লিখুন এবং সে বিষয়ে কী করবেন লিখে ফেলুন। এতে দুশ্চিন্তা কমবে ও ঘুম হবে।
? ঘুম না এলে ‘কেন ঘুম হচ্ছে না’ শুয়ে শুয়ে তা ভাববেন না। বরং উঠে পড়ুন, যা করতে ভালো লাগে করুন বই পড়ুন, টিভি দেখুন বা হালকা গান শুনুন। কিছুক্ষণ পর ঘুম আসার মতো যথেষ্ট ক্লান্ত বোধ করলে বিছানায় যান।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্খ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
সংগৃহীত ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন