ফেরা
প্রথম অংশ
আল্লাহর নামে শুরু করলাম আমার জীবনে প্রথম লেখা গল্প, কুকুরটা বার বার ঘেউ ঘেউ শব্দে জাকিরের মায়ের পাশে পাশে ঘুরা ঘুরি করতেছে ।
আজ বড় বেশি ঘেউ ঘেউ করতেছো যে, খাওয়ন কম হইছে ? দেখতাছসনা কাম করতেছি, আমার তোরে খাওয়ন দেওনের সময় কই । কাল বাদে পরশু ঈদ আমারার জাকির বাড়ি আইতাছে আমরার লগে ঈদ করবো । আমার হাতে অহন কোন সময় নাই, কত দিন পর পোলাডা বাড়ি আইবো । তোর কি ?
তুই কি বুঝবি তোর তো গত মাঘে চারটি পোলাপান হইলো একটারে ও তো তোর লগে রাখতি পারলিনা , হেইটা নিয়া তোর কোন দুঃখ নাই । খালি খাওয়ন আর খাওয়ন । পোলা আমার মেস বাড়িতে থাকে হুনছি , ঐহানকার খাওয়ন দাওয়ন ভালানা তাইতো পোলাডার শরীর মাঝে মাঝে খারাপ করে । হেইডা তুই যেমন বুঝসনা পোলার বাপও তেমন বুঝেনা । আজ রাতের লঞ্চে উঠবো আইতে আইতে ফযর ওয়াক্ত হইবো রাতে আমার কি ঘুম হইবো ! বাপজান আমার কতক্ষনে আইবো চোখের দেখাটা দেখুম তোর কি এই সব চিন্তা আছে ?
ছোট মেয়েরে ডাকে আছরিন ও.. আছরিন তোর বাপজানরে কও । গোয়াল পাড়ায় গিয়া ১ সের দুধ নিয়া আইতো আর সকাল সকাল হাটে যাইতো । তোর আপারে কও ভাইজানের বিছানা গোছায়া রাখতে । পোলা আমার কত ধকল সেরে আইবো এইটা কারো আন্দাজ হয়, না কারো কোন মাথা ব্যাথা আছে " বিকেলের শেষ ভাগ হাতের কাজ সেরে জাকিরের মা চলল পুকুর ঘাটে। তার পর শুধুই অপেক্ষা ------
দ্বিতীয় অংশ
জাকিরের বাবার মনে মনে খুশিটা একবারে কম নয় । গোয়াল পাড়া হতে ফিরেই ছুটল বাজারের উদ্দেশ্য, ঈদের বাজার সহ, কত কাজ তার পড়েছে । আজ তার ইফতারের আগে বাসায় ফেরা চাই তার, ইফতার বাদ- খাবার সেরে আবার গায়ের মসজিদে গিয়া তারাবী নামাজ আদায় করে বড় রাস্তায় যেতে হবে এইসব ভাবতে ভাবতে ভাইজান- ও ভাইজান ডাক শুনতে পেলেন এক পরিচিত কন্ঠের, ফিরেই দেখল পাশের পাড়ার মজনু মিয়া ।
-ভাইজান একটা আতর লইয়া যান ।
-আতরের দোকান বহাইলা কোন দিন ?
-এইতো দুই তিন দিন হইলো ভাইজান , ঈদের লাইগা দোকান সাজাইছি আরকি ।
-ভালা করছোছ , তো বেচা বিক্রি হয় তো ভালো ?
-হ ভালাই হইতাছে । ভাইজান বাজার সদাই তো অনেক টি করছেন, পোলাই বুঝি টাকা পাঠাইছে ? --হ পোলাই তো টাকা পাঠাইবো আমরার আর কে আছে কহ টাকা দেওনের ।
-পোলাটা বাড়ি আইবোনা ?
-আইবো তো , তাই তো এতোটি সদাই লয়লাম । তোর ভাবি সাব ফর্দ কইরা দিছে পোলাই আইবো,
-তাই তার হেইগুলান সদাই লাগবোই । তা ছাড়া আমরার আর কি এও গুলান বাজার সদাই লাগবো কও । গালভরা হাসি নিয়ে জাকিরের বাবা এইসব বলছে আর বুকের ভিতরের আনন্দটা যেন ঠিকরে বের হচ্ছে । তার সারা মুখের উজ্জ্বল রেখার মাধ্যমে । আ-হা সেকি যে আনন্দ ছেলের কথা বলতে বলতে গর্বে বুকটা ফুঁলে ফেঁপে একাকার ।
-হেরা কামাইবো হেরা খাইবো , আমরার আর কি কও ? হেইটাই আমরার বাব মার সুখ কি কও তুমি ?
- হ ভাইজান একদম হাসা কথা কইছেন । তো পোলার লাইগা একটা আতর দিমুনি ,
-হ কইছো যহন দেও । আর ঈদের দিন ঈদ গায়ে নামায পইড়া বাড়িতে পাইসো কইলাম । দাওয়ার রইল তোমার । পোলাড়ারেও সঙ্গে নিও । বাড়িতে আইসো তোমার ভাবিসাব অনেক খুশি হইবো । জাকিরের বাবা আবার দুই হাতে শক্ত করে বাজার ভর্তি মাঝারি সাইজের দুটি ব্যাগ ধরে মনের খুশিতে হামদ নাথ গাইছেন আর চলছেন । সেই চির চেনা পথটি ধরে । যেটা এঁকে বেঁকে গ্রামের ভিতর দিয়ে ----
তৃতীয়
- চলে গিয়াছে জাকিরদের বাড়ি অবধি । এই পথটি জাকিরের বাবার যেমন (৩৫) পঁয়ত্রিশ বছরের চেনা , তেমনি পথ ও তার চার পাশের গাছ পালা পরিবেশ প্রতিটি ধুলি কণা ও জাকিরের বাবাকে ভালো করে জানে ও চেনে ! এটা যে পথ পরিবেশ ও পথিকের নিবির বন্ধন ।
কিন্তু!
- আজ যেন জাকিরের বাবাকে একটু অজানা লাগছে সেই চির চেনা - জানা পরিবেশ ! মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল চোখ দুটিতে মলিন ভাবটি নেই । ক্লান্তি নেই শ্রমে ভাঙ্গা শিন শিনে শরীর টাতে , সেটা আজ বড়ই উদ্বাস ,বুকটা যেন, রাজপ্ররীর মতো সাহসী, অন্যের কাজে ব্যবহ্রত হাত দুটিতে ।
-সরকারদের মত সদাই ভর্তি দুটি ব্যাগ কন্ঠে বেসুরো গান । আজ পথ চলার সব আনন্দ যেন তার সঙ্গী ।
- যে আজ দুর্বার তাকে কোন বাধায় যেন আটকে রাখতে পারবেনা । ইফতারের সময়টা কাছে আসছে ভেবে, দ্রুত চলার আনন্দে । তাইতো জাকিরের বাবাকে আজ অচেনা লাগছে এই পরিবেশ ।
- আজকের আগে এই লোকটাকে এমন রুপে দু-একবার দেখা গিয়েছিলো, তাও আবার অনেক দিন আগে । তা প্রায় ১৬-১৭ ষোল-সতের বছর আগে একবার । যখন জাকিরের মায়ের সাথে তার বিয়ের সম্বন্ধ তৈরি হয় । আর একবার এই সময়ের কিছু আগে যে বছর পাশের গায়ের সঙ্গে নিজ গায়ের ফুটবল খেলায় ফাইনাল ম্যাচে উমেশ চন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে । দুই গায়ের কয়েক হাজার দর্শকের মাঝে তুমুল উত্তেজনার ম্যাচে ১-০ গোলে নিজ গায়ের সম্মান বাড়িয়ে দিলেন, এবং নিজে হলেন ম্যাচ সেরা ।
-ম্যাচ সেরার পুরুস্কার প্রধান অতিথি থানার অফিসার নিজে তার গলায় পড়িয়ে দিলেন । আর মাত বরের নির্দেশে দলের অন্যরা তাকে কাঁদে স্লোগান দিয়ে সারা গায়ে গুড়িয়ে আনলেন । তখন সারা গায়ে যে হই হই রব পড়ে গিয়েছিল সবার মুখে মুখে, সাথে গায়ের লোকের খাতির যত্ন ও কম পাননি তিনি ।
চতুর্থ
তার বিয়ের দুই বছরের মাথায় তার পিতা পরলোকগমন করলেন , আর জাকিরের বয়স তখন ছয় সাত মাস । এর পর সংসার যুদ্ধ সারা বছর অন্যের জমিতে কাজ , পাশা পাশি সরকারদের গদিতে কাজ করে করে সংসার চালাতে হতো । এত্ কিছুর পরও মাঝে মাঝে ধার-দেনা করে সংসার চালাতে হতো । সংসার জীবনে অভাব অনাটন কখনোই পিছু ছাড়েনি তার,
- নিজের জীবনে মত অভাবটাও তার যেন ছায়া সঙ্গী হয়েয় ছিল । বছর দুই আড়াই হল তার চাল চিত্রটা পাল্টেছে । জাকির পড়ালেখা করেছে এস এস সি পর্যন্ত । পড়ালেখার পাশা পাশি বাবার সাথে অন্যের জমিতে কাজ করে বাবার কাদটাকে একটু হালকা করতো । তা না হলে যে, ছোট দুই বোন বৃদ্ধা দাদী ও নিজে সহ ছয় জনের সংসার বাবার একার পক্ষে চালিয়ে নিতে বড়ই কষ্ট হচ্ছিল । তারপরও সংসারের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপের দিকে যেতে থাকলো ......
-অতপর জাকির এস এস সি (মাধ্যমিক) পরিক্ষা দেওয়ার পর গায়ের এক লোকের সাথে ঢাকায় এসে, এক মাস নিজ খরছে থাকা - খাওয়ার শর্তে, একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে লাইন ম্যান হিসেবে চাকুরীতে যোগ দিলেন ।
-এর ঠিক কিছু দিন পর হতে সময়টা পাল্টাতে শুরু করলো তাদের, এখন ধার-দেনা করতে হয়না জাকিরের বাবাকে ।
বরং বাড়ির ছনের ঘর দুটি এখন দো-চালা টিনের ঘর হয়েছে । দুটি গরু পাঁচ ছয়টি ছাগল সহ বেশ সচ্ছল সংসার এখন তাদের । জাকিরের বাবা সখ করে একটি কুকুর ও পোষেন, যেটা ওদের সংসারের একজন সদস্যের মত, সে ও এখন তাদের সুখ দুঃখের অংশীদার ।
শেষ অংশ
সব মিলিয়ে বেশ ভালোই চলছে জাকিরদের সংসার । জাকিরের পাঠানো টাকায় বৃদ্ধা মায়ের ঔষধ পওর, ছোট মেয়ে দুটির স্কুলের খরচ এবং তাদের নানাবিধ আবদার মিটিয়ে নিজেও বেশ ফুর ফুরে মেজাজে সরকারদের মতো পনচুর দোকানে এখন একটা দুধ চায়ের অর্ডার করেন । তখন বেশ ভালোই লাগে জাকিরের বাবার ।নিজের দুটি পা দুলিয়ে দুলিয়ে সেই চা টার সবটুকু মজা নিগড়ে নিতে কোন ভুল হয় না তার । শরীরটা দেখে খুব একটা বুঝার উপায় নেই যে, জাকিরের বাবার কতটা খুশি ?
- কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা (জাকিরের পরিবার ) এমন একটা দুঃসংবাদ সুনবে কল্পনাও করতে পারে নায়! জাকিরদের বাড়ির সামনে একটা মাইক্রোবাস এসে দাড়ালো । সবাই খুশী মনে এসে যা দেখলো তা কল্পনাও করা যায় না ! জাকির এসেছে ঠিকি কিন্তু লাশ হয়ে । আসার সময় গাড়ী দুর্ঘটনায় মারা জাকির মারা গেছে । যেখানে আনন্দের বন্যা বইত আর সে সোখের ছায়া নেমে এল এমন ফেরা কেও কখনো নায়না ।